ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুতেও পরিবর্তন ঘটে। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস হালকা হিমেল বাতাস দিয়ে জানান দেয় শীতকাল আসতে চলছে। কৃষকের মাঠ গুলো সোনালি ধানের হাসিতে ভরে ওঠে। শুরু হয় বাঙালির নবান্নের উৎসব যা চলে পুরো শীতকাল ব্যাপি। হেমন্তঋতু ও শীত ঋতু বাঙ্গালির জীবনে অনেক বেশি প্রভার বিস্তার করে অন্য ঋতুর তুলনায়। চারদিকে চলা নতুন ধান দিয়ে নবান্ন উৎসবের আয়োজন এখন বাঙালির একটি সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।বাঙালির জীবনে পিঠা ও শীতকালীন সংস্কৃতির প্রভাবশীতকালে মানে বাঙালির উৎসব উৎসব ভাব। পৌষ ও মাঘ মাস বাংলাদেশে শীতকাল হলেও নতুন চালে পিঠা খাওয়ার ধুম শুরু হয় কার্তিক মাসে নতুন ধান কাটার পর থেকেই। কার্তিকের মরা মঙ্গাকে অতিক্রম করে কৃষকের গোলা নতুন ধানে ভরে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন চালের গুড়া দিয়ে পৌষ পার্বণে পিঠা খাওয়ার প্রচলন অনেক প্রাচীন। অগ্রহায়ণ মাসের গোলা ভরা ধান থেকে করা নতুন চাল দিয়ে গ্রামের মা চাচি দাদি নানিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন পিঠা বানানো নিয়ে যা আমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ।প্রত্যেক দেশেরই লোকজ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকে। শীতের পিঠা বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীত আর পিঠা একে অপরের পরিপূরক বলা যায়।শীতের সকালে রোদে বসে নতুন চালের ধোঁয়া ওড়ানো গরম গরম পিঠাপুলি খাওয়ার মজাই আলাদা। নতুন চাল, খেজুরের রসের নতুন গুড়ে টইটম্বুর পিঠা বাঙালির শীত উদ্যাপনকে রঙিন ও উৎসবমুখর করে তোলে।শীতকালীন বাঙালির সংস্কৃতিবাঙালির লোকজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলি ভূমিকা প্রাচীনকাল থেকেই। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গ্রামের বধূরা পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করে। হরেক রকমের রসনাজাতীয় পিঠা পায়েস দিয়ে গ্রামের মায়েরা ব্যস্ত হয়ে পরে নতুন জামাইকে আদর আপ্যায়ন করাতে।একসময় গ্রামে গঞ্জে মেয়েদের নতুন বিয়ের পরপর শশুড়বাড়িতে গুড়-মুড়ি-চিড়ে, পান-সুপারির সঙ্গে পাঠানো হতো বিশাল ডালাভর্তি অথবা রঙিন হাঁড়িভর্তি ফুলপিঠা, পাক্কন পিঠা। কিন্তু কালের আবর্তে এখন আর সে সংস্কৃতি নেই। তবে এখন এই সময়টাতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই সাবলীল থাকার কারণে চলে বিয়ে শাদী, সুন্নতে খাৎনা,, বড় করে গায়ে হলুদ, মুখে ভাত, অতিথি আগমনের অনুষ্ঠান। আর এসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সামাজিক রীতি নীতির সাথে থাকে পিঠা পুলির ব্যবহার। আমাদের দেশে আত্মীয়স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও মজবুত করতে মুখরোচক রসে টুইটুম্বর পিঠা-পুলির উৎসব বিশেষ ভূমিকা পালন করে।শীতকালীন পিঠার ঐতিহ্যপ্রত্যেক দেশেরই ঐতিহ্যবাহী কিছু মিষ্টান্ন থাকে যা তাদের খাদ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশ ও বাঙালির ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে পিঠা। পিঠা শুধু আমাদের জন্য লোকজ খাবারই নয়, পিঠা আমাদের বাঙালির স্মৃতি ও লোকজ সংস্কৃতির ভাণ্ডার ও ঐতিহ্যও বটে। প্রাচীন বাংলায় মিষ্টান্ন হিসাবে পিঠার জনপ্রিয়তাই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে শীতে মানেই আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি পিঠা-পুলির উৎসব। শীত মানেই গরম গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠাপুলি, ক্ষির-পায়েস খাওয়ার ধুম। শীতের পিঠা পুলির গোড়াপত্তন গ্রামে হলেও এটি বাঙালির শেকড়ের আদি ঐতিহ্য। একসময় শুধুমাত্র শীতের পিঠার জন্য শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এখন পরিবারের সবাই মিলে সে পিঠা খাওয়ার সেই উৎসব রীতি অনেকটাই ম্লান।পিঠা কত প্রকার ও কিকিএমন অনেক পিঠা আছে যা সারাদেশেই জনপ্রিয়। এগুলি হচ্ছে এগুলি হচ্ছে ভাপা পিঠা, চিতুই পিঠা, ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, দুধ চিতই, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জেলাফি, বিবিখানা, চুটকি, চাপড়ি, ক্ষীর কুলি, গোকুল, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল, জামদানি, ঝালপোয়া, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নকশি, চাঁদ পাকান, ছিট, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান, পানতোয়া, মালপোয়া, মালাই, মুঠি, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া, দুধরাজ, ফুল ঝুরি, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা, সেমাই পিঠা প্রভৃতি। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা এবং চিতুই পিঠা। কালের গভীরে কিছু পিঠা হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রামবাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও এখন পিঠা পাওয়া যায়। পিঠা তৈরির সাধারণ উপাদান হচ্ছে চালের গুঁড়া, ময়দা, খেজুর গুড় বা চিনি, নারকেল ও তেল। অনেক সময় কিছু কিছু পিঠাতে মাংস ও সবজি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে জনপ্রিয় কয়েকটি পিঠাভাপা পিঠাবাংলাদেশে জনপ্রিয় আরেকটি পিঠা হলো ভাপা পিঠা। এ পিঠাকে কোথাও ধুপি পিঠা বা ধুকি পিঠা নামে পরিচিত। বাষ্পে সিদ্ধ করা হয় বলে এই পিঠার নাম ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়ো দিয়ে করা ছোট ছোট পিঠার মাঝখানে খেজুরের রসের নতুন গুড় আর নারিকেল থাকে।নকশি পিঠাবাংলাদেশ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি বড় উদাহরণ নকশি পিঠা। পাক্কান পিঠা, ফুল পিঠা ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বেশি তৈরি হয়। চালের খামির বানিয়ে মোটা মোটা করে বেলে তার ওপরে খেজুর কাঁটা দিয়ে একটু গভীর করে আলপনা আঁকা হয়। এগুলোকে বলে ফুল নকশি পিঠা, পাক্কান পিঠা বা সুঁই কাটা দিয়ে নকশা করা মুগপাক্কন পিঠা। তবে এর গোলাতে মুগ ডাল লাগে।চিতই পিঠাচিতই পিঠা বাংলাদেশের সব অঞ্চলের ধনী-দরিদ্র সবার কাছে পরিচিত ও প্রিয়। শহরের অলিগলিতেও দেখা যায় এ পিঠা। অনেক রকম ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়া হয়। চিতই পিঠা খেজুরগুর ও নারকেলের পুর বা দুধে ভিজিয়ে খাওয়া হয়। পাটিসাপটা পিঠাপিঠার কথা উঠলে পাটিসাপটা পিঠার কথা বলতেই হবে। চালের গুঁড়ো ও খেজুর গুড়ের মোলায়েম আবরণের ভেতর ঘন দুধে তৈরি পায়েস বা নারকেল দিয়ে তৈরি করা হয় পাটিসাপটা পিঠা। এলাকাভেদে পাটিসাপটা পিঠা পরিবেশন ভিন্ন হলেও সবগুলোই হয় অনন্য সুস্বাদু।পুলি পিঠা
পুলি পিঠাও বিভিন্ন উপায়ে তৈরি করা যায় ও খাওয়া যায়। তবে ঐতিহাবাহী পুলি পিঠা গুড় ও নারকেলের পুর দিয়ে তৈরি করা হয়। দুধ পুলিকে দুধে ভিজিয়ে রাখা হয় এবং স্বাদের জন্য মশলা ও খেজুর গুড় ও নারকেল ব্যবহার করা হয়। পুরে ভরা পুলি পিঠা তেলে ভাজা হয়।অঞ্চল ভেদে কিছু দেশীয় পিঠাবাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এ রকম অসংখ্য নাম জানা-না জানা ঐতিহ্যবাহী পিঠা। অঞ্চল ভেদে কখনো কখনো একই পিঠার নাম অন্য রকম হয়। ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে আছে গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছানার মালপোয়া, বিবিখানা পিঠা, কলা পিঠা, মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, তিল পুলি, সাবুর পিঠা। নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের কিছু ঐতিহ্যবাহী পিঠা হল ডিমের পানতোয়া, খোলাজা পিঠা, নারিকেল পুলি পিঠা, নারিকেলের চিড়া। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠা হল আতিক্কা পিঠা, বিন্নি পুলি, বিবিখানা পিঠা। সিলেটের গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠার মধ্যে অন্যতম হল চুঙ্গাপুড়া পিঠা, নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষের প্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী পিঠা হল হাতে বানানো হাত সেমাই পিঠা। উপসংহার
পিঠা তৈরি আবহমান বাংলার মা মেয়েদের ঐতিহ্য। একসময় আমাদের দেশে শত শত নামের ধান ছিল, তখন বিচিত্র রকমের পিঠার নামও ছিল। পিঠা-পুলিকে কেন্দ্র আমাদের অনেক গান কবিতাও রচিত হয়েছে। তাই পিঠা পুলি অনেকটা আমাদের লোকজ সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ বলা চলে। এতো বিচিত্র রকমের পিঠা হয়তো আর কোনো দেশে তৈরি হয় না। হাজারো বাধা ও সমস্যা সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় মা বোন চাচি খালাদের পৌষ পার্বণে পিঠা বানানোর উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। শীতকালে নবান্নের সময় পিঠা-বানানোর এ আনন্দ ও ঐতিহ্য টিকে থাকুক যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে।
Read more